টাকায় মেলে লঞ্চ চালানোর সার্টিফিকেট!

NEWSNEWS
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  04:16 AM, 02 January 2022

বিশেষ প্রতিবেদকঃ টাকা দিলেই মেলে লঞ্চের চালক ও মাস্টারের সার্টিফিকেট। নৌযানগুলোর সার্ভে রিপোর্ট নদীতে নয়, অফিসে বসেই আর্থিক লেনদেনেই শেষ হয় বলে জানান লঞ্চ মাস্টাররা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসামগ্রী থাকে না লঞ্চগুলোতে। যাও বা আছে, তা ব্যবহারই করতে জানেন না স্টাফরা।ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ নৌপথকেই বেছে নেয়। চাকচিক্যে ভরা নিত্যনতুন লঞ্চও নামছে নদীতে। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনায় নিরাপত্তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ঢাকা বরিশালসহ দক্ষিণের নদীতে ৬০টিরও বেশি লঞ্চ চলে। তবে এগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন, যাত্রী তুলনায় বয়া ও লাইফ জ্যাকেট না থাকা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা শূন্যতা থাকে বলেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান এ পথের পর্যবেক্ষকরা।অন্যদিকে মাস্টার নির্দেশনা দেন, সুকানি নৌযান পরিচালনা করেন, আর ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করেন ড্রাইভার- এই তিনজনের সমন্বয়ের মাধ্যমেই চলে বড়-ছোট নৌযান।

কিন্তু মাস্টার-সুকানির বদলে নৌযান চালাচ্ছেন কেবিনবয়। প্রশিক্ষণবিহীন অদক্ষ মাস্টার, সুকানি এবং ড্রাইভারের সমন্বয় না হওয়ায় প্রায়ই ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানি হচ্ছে, চিরতরে পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। ক্ষতি হচ্ছে বিপুল সম্পদের।যার সব শেষ সংযোজন ঝালকাঠিতে অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি।বরিশাল নদীবন্দরে কবির নামে একজন যাত্রী জানান, বর্তমানে যেভাবে নৌ দুর্ঘটনা হচ্ছে তাতে যে-কেউ বুঝতে পারে যে, অদক্ষদের দিয়ে ময়ূর-২ লঞ্চটি চালানো হচ্ছিল। মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষায় অভিজ্ঞ মাস্টার, সুকানি ও ড্রাইভার দিয়ে যাত্রীবাহী নৌযান চালানোর দাবি জানান তিনি। এদিকে প্রশিক্ষণবিহীন অদক্ষরা লঞ্চ চালানোর দায়িত্ব পাওয়ার জন্য টাকার বিনিময়ে মাস্টার, সুকানি ও ড্রাইভার সার্টিফিকেট কিনছেন বলে অভিযোগ করেছেন অভিজ্ঞ নৌযান মাস্টাররা। তাদের দাবি, বিগত সময় (নৌ-পরিবহনমন্ত্রী মো. শাহজাহান খানের আমলে) টাকার বিনিময়ে ৯০ ভাগ সার্টিফিকেট এসেছে। অথচ যারা লঞ্চ চালাতে চালাতে ২০ থেকে ৩০ বছরের অভিজ্ঞ কিন্তু লেখাপড়া কম বা অশিক্ষিত, তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। নৌ সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে এই অনিয়ম-দুর্নীতি চলে আসছে বলে অভিযোগ করেন বরিশাল-ঢাকা রুটের বিলাসবহুল এক লঞ্চের মাস্টার ।

তার দাবি, যতবার দুর্ঘটনা ঘটে ততবার তদন্ত কমিটি হয়। অথচ যারা সার্টিফিকেট বাণিজ্যের জন্য দায়ী তারাই থাকেন তদন্ত কমিটির দায়িত্বে! এ কারণে কোনো দুর্ঘটনার আজ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক বিচার কিংবা সুপারিশ কার্যকর হয়নি।নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল নদীবন্দরের একজন প্রবীণ নৌযান শ্রমিক বলেন, তিনি গত ৩০ বছরে অন্তত চারবার মাস্টার হওয়ার পরীক্ষা দিয়েছেন। চাকরি করেন বাংলাদেশের নৌযানে, অথচ পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয় ভারত, লন্ডন ও সিঙ্গাপুরের নৌ-সংক্রান্ত প্রশ্ন। কারণ তিনি টাকা দিতে পারেন না। এ কারণে তিনি মাস্টারও হতে পারেননি। তার মতো অনেকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণির মাস্টার পদে উন্নীত হওয়ার পরীক্ষা দিলেও বারবার তাদের ফেল করিয়ে দেওয়া হয় শুধু দালালের মাধ্যমে না যাওয়ার কারণে। বরিশাল সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, কী পরিমাণ যাত্রী ধারণ করা হয়েছে সেটা নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা যে পরিমাণ থাকার কথা সেটা নাই।লঞ্চচালকরাই জানান, অবৈধ আর্থিক লেনদেনে তাদের সনদ মেলে। লঞ্চের সার্ভে রিপোর্ট হয় ঘুষের বিনিময়ে। বরিশাল বিভাগ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হাশেম খান বলেন, টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট আসতেছে। আপনি জাহাজে বসে আছেন মতিঝিল থেকে আপনার সার্টিফিকেট এসে গেছে।

এদিকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মেরিন সেফটি স্পেশাল অফিসার সৈয়দ মোরাদ আলী বলেন, এই লঞ্চের অমুক মালিকের কাছ থেকে অমুক টাকা চেয়েছে সেক্ষেত্রে আমাদের অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। ডিজি মহোদয় অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি, এসব বিষয়গুলোতে তিনি অত্যন্ত কঠোর, তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।লঞ্চে নিরাপত্তাসামগ্রী যদিওবা আছে, তা অনেকে ব্যবহারই করতে জানে না স্টাফরা। লঞ্চ মালিকরা প্রশিক্ষণের দাবি করেছেন। দাবি করেছেন, আধুনিক নিরাপত্তাসামগ্রী যুক্ত আছে বড় লঞ্চগুলোতে।বরিশাল লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, স্টাফদের আরও ভালো প্রশিক্ষণ দিতে হবে।আর বিআইডব্লিউটিএ বলছে, এখন থেকে তারা আরও বেশি সতর্ক হচ্ছেন।বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের আরও তদারকি করার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। সেই তদারকি আমরা আরও যাতে করতে পারি, যাত্রীরা যাতে নিরাপদে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

আপনার মতামত লিখুন :