ঢাল-তলোয়ারহীন একটি প্রতিষ্ঠান বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশন

নদীপথের নিরাপত্তায়

NEWSNEWS
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  11:08 PM, 29 December 2021

অনলাইন ডেস্কঃ নদীতে অগ্নি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নৌ ফায়ার স্টেশনের সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজের নাম ‘অগ্নিঘাতক’। বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন এ জাহাজটির স্থায়ী ঠিকানা নগরীর পরিত্যক্ত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতীরে। সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে।অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে ‘অগ্নিঘাতক’ রাত ৩টা ২০ মিনিটে রওনা হয়ে শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। অর্থাৎ ১৭ কিলোমিটার দূরের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে অগ্নিঘাতকের সময় লেগেছে ১২ ঘণ্টা। নৌ ফায়ার স্টেশনের আরও দ্রুতগামী যান স্পিডবোটটি একই সময়ে রওনা হয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৬টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

রাতের কুয়াশা ভেদ করে নৌযান দুটির চলার সক্ষমতা না থাকায় এ অবস্থা হয় বলে জানা গেছে। নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশনটির এটি একটি খন্ড চিত্র মাত্র।এটি বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার জন্য একমাত্র নৌ ফায়ার স্টেশন। প্রতিষ্ঠানটি নানামুখী সংকটে জর্জরিত। নেই দ্রুতগতির আধুনিক নৌযান, উদ্ধার অভিযান সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় জনবল। দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে নেই একটি রিভার অ্যাম্বুলেন্স। অথচ উপকূলের ১০ জেলায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথে (নদনদী ও সাগর মোহনায়) যে কোনো নৌদুর্ঘটনা পরবর্তী জানমালের নিরাপত্তা ও উদ্ধার অভিযানের দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির। তাদের দুরবস্থা দেখলে মনে হবে নদীপথের নিরাপত্তায় ঢাল-তলোয়ারহীন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশন।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল দপ্তরের উপসহকারী পরিচালক বেল্লাল হোসেন বলেন, পটুয়াখালীতে আরেকটি রিভার ফায়ার স্টেশন থাকলেও সেখানে একটি স্পিডবোট ও দু’জন ডুবুরি আছেন। ১০ জেলায় যে কোনো অগ্নিকান্ডসহ যে কোনো নৌ-দুর্ঘটনায় জীবিত-মৃতদের উদ্ধার কাজটি বরিশাল রিভার ফায়ার স্টেশনকে করতে হয়। তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম না থাকায় সংশ্নিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (কোস্টগার্ড, বিআইডব্লিউটিএ এবং নৌ পুলিশ) সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করেন। সংকটের বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা সমাধানের আশ্বাসও দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির ডুবুরি দলনেতা হুমায়ুন কবির বলেন, ১০ জেলার জন্য আছেন মাত্র চারজন ডুবুরি। তাদের দু’জন থাকেন পটুয়াখালী স্টেশনে। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে একটি করে স্পিডবোট রয়েছে। একমাত্র শক্তিশালী জলযান অগ্নিঘাতক ১৯৯৩ সালে নির্মিত হয়।

সেটির গতি কমে গেছে। কুয়াশা ভেদ করে চলার শক্তিশালী রাডার নেই এ জাহাজে। স্পিডবোটেরও একই অবস্থা। ডুবুরিদের জন্য বরাদ্দ ডাইভিং (নদীতে ডুব দেওয়ার) সরঞ্জামও অনেকটা অকেজো।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কানেকটিং ফাইট, অ্যাঙ্কর, বিসিডি, অরিন, বাইনোকুলার, লাইফ লাইন ও ডাইভিং স্যুট। অগ্নিঘাতকের চালক রিপন ও এনামুল বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে রাত ৩টা ২০ মিনিটে রওনা দেন তারা। ঘন কুয়াশায় ৫ হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। পথে জাহাজটি দিক হারিয়ে একটি ডুবোচরে আটকে যায়। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেলে জাহাজটি চর থেকে মুক্ত হয়ে বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কিন্তু এর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। ‘অগ্নিঘাতক’ ঘণ্টায় মাত্র ৮ নটিক্যাল মাইল চলতে পারে বলে জানান ওই দুই চালক। রিপন ও এনামুল আরও বলেন, বর্তমান সময়ে নির্মিত জাহাজের গতি ঘণ্টায় প্রায় ২০ থেকে ২২ নটিক্যাল। অগ্নিঘাতকের ইঞ্জিনসহ সবকিছুই এখন মান্ধাতা আমলের হওয়ায় এটি অচল সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। আরেক ডুবুরি রাব্বি বলেন, অগ্নিঘাতকের সঙ্গে তিনি আরেকটি স্পিডবোটে ঘটনাস্থলে রওনা হন।

কুয়াশায় দিক হারিয়ে তার বোটটিও একটি চরে আটকে পড়ে। পরে স্থানীয় এক গ্রামবাসীকে বোটে তুলে তার দেখানো পথে সকাল সাড়ে ৬টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান। যদিও এর আগেই ঝালকাঠি ফায়ার স্টেশন পাবলিক ট্রলারে পানির পাম্পসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। রাব্বি বলেন, ডুবুরি সংকটের কারণে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ও ব্যতিক্রমী দুর্ঘটনায়ও উদ্ধার কাজে মাত্র দু’জন ডুবুরিকে কাজ করতে হয়েছে। ১০ জেলার যেখানেই নৌদুর্ঘটনা, সেখানেই ডাক পড়ে তাদের। খোলা পিকআপে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে তারা নিজেরাই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এত সংকটের মধ্যে বিশাল এ অঞ্চলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা কঠিন।যোগাযোগ করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভুইয়া স্বীকার করেন, উপকূলীয় এলাকা বরিশালের জন্য নৌ ফায়ার স্টেশনটি যুগোপযোগী নয়। এখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আধুনিক ও দ্রুতগতির অগ্নিনির্বাপণ নৌযান। এ ছাড়া দূরত্বের কারণে বরিশাল শহর থেকে বিভাগের ছয় জেলা ও ঢাকা বিভাগের চার জেলায় সেবা দেওয়া কষ্টকর। এজন্য আরও কয়েকটি নৌ স্টেশন প্রয়োজন। বিশেষ করে হিজলা উপজেলা সংলগ্ন মেঘনায় এবং পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় পৃথক দুটি নৌ স্টেশনের প্রয়োজনীতা আছে।কামাল উদ্দিন ভুইয়া বলেন, সংকটের বিষয়গুলো আগে থেকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান গত সোমবার ঝালকাঠিতে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি বরিশালে বৈঠক করেছেন। তখন তাকে এখানকার ফায়ার স্টেশনের বাস্তব চিত্র জানানো হয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

আপনার মতামত লিখুন :