বরিশালের নয়ানীতে অবৈধ সিকো ব্রিকফিল্ডে দেদারছে পুড়ছে কাঠ

NEWSNEWS
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  09:16 PM, 27 December 2021

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বরিশালের একটি ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এ জন্য আইন ভেঙে ভাটার ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে করাতকল। বরিশাল সদর উপজেলার ৭নং চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী এলাকায় সিকো ব্রিকফিল্ডে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে কৃষিজমির মাঠে ইটভাটাটি স্থাপন করা হয়। এ ভাটায় প্রতিবছর নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট তৈরি করা হয়। এখানে প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিবছর ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট উৎপাদন করা হয়। কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও এখানে তা মানা হচ্ছে না।

গত শনিবার সিকো ব্রিকফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার বিভিন্ন স্থানে পোড়ানোর জন্য কাঠ মজুত করা হয়েছে। শ্রমিকেরা ট্রলিতে ভরে কাঠ এনে ইট পোড়ানোর স্থানে স্তূপ করে রাখছেন। কাঠ চেরাইয়ের জন্য ইটভাটার ভেতরে করাতকল স্থাপন করা হয়েছে। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করায় ইট পোড়ানোর মৌসুমে প্রচুর বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। এতে আশপাশের জমিতে ধানের আবাদ ও এলাকার ফলদ গাছপালার উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। নয়ানী এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিল, সাইফুল ইসলাম সহ ১০-১২ জন কৃষক বলেন, তাঁরা সারা বছর মাঠের ফসলের আবাদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাঁদের গ্রামের এই ফসলি জমিতে ইটভাটাটি স্থাপনের পর থেকে তাঁদের ফসল উৎপাদন কমে গেছে। ফলদ গাছেও ফল কম ধরে। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী বিনা লাইসেন্সে কেউ ইট তৈরি করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না। করলে তিনি অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯-এর তথ্য থেকে জানা যায়, আবাদি জমিতে কোনো ইটভাটা তৈরি করা যাবে না।

পরিবহনে এলজিইডির রাস্তা ব্যবহার করা যাবে না। কাঠ পোড়ানো যাবে না। কিন্তু এর কিছুই মানছেন না বরিশাল সদর উপজেলার ৭নং চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী এলাকায় সিকো ব্রিকস। উক্ত আইনে আরও উল্লেখ আছে, ইট পোড়ানোর সংখ্যা রেজিস্ট্রার বইয়ে লেখার কথা থাকলেও সিকো ব্রিকস প্রকৃত সংখ্যা লিখেন না। কারণ জানতে চাইলে ম্যানেজার জানান, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার জন্যই প্রকৃত সংখ্যা লেখা হয় না। নয়ানীর সবজি চাষী আবদুল বাতেন জানান, তার বাড়ির পাশে সিকো ব্রিকস ইটের ভাটা। রাত-দিন সেখানে পুড়ছে ইট, উড়ছে ধোঁয়া আর গ্রামের প্রতিটি কাঁচা-পাকা সড়কে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ইটবাহী ট্রাক্টর গাড়ির ভয়ংকর শব্দ। ইটভাটার ধূলোবালি ও গাড়ির অত্যাচারে গ্রামবাসী অসহায়। জানাগেছে, ইটের ভাটা দিতে হলে পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র, কৃষি বিভাগের ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র,বিএসটিআই ইত্যাদি যাবতীয় অনুমোদন নিয়ে হয়। কিন্তু সিকো ব্রিকফিল্ডের এসকল কাগজপত্র দেখাতে রাজি হয়নি মালিক পক্ষ।

সিকো ইটভাটার এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ইটে ব্যাপক লাভ। সে কারণে ইটের ব্যবসা করেন অনেকে।তার মতে, আমাদের ব্রিকসের মালিক একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার মুখে শুনেছি বরিশালের বিভিন্ন সাংবাদিক ও প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের সাথে তার ভাল সম্পর্ক আছে। তার কেউ তার কিছুই করতে পারবে না। অসমর্থিত একটি সূত্র জানায়, অবৈধ ভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ যেন ভেঙে না দেয় সে জন্য বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তা-বাবুদের কাঁচা টাকা দিয়ে রাতারাতি সব ম্যানেজ করে রেখেছেন। তাদের লাখ টাকা মাসোহার দেয়া হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, সিকো ব্রিকস নদীর পাশে হওয়ায় আশপাশে জেগেওঠা চর থেকে মাটি কেটে বিশাল মজুদ করা হয়েছে। এছাড়া মালিকানাধীন ফসলি জমি থেকেও মাটি কেটে আনছে সিকো ব্রিকসের শ্রমিকরা। ভাটাটিতে কোথাও কয়লা চোখে পড়েনি। কেবল গাছপালা ও বাঁশের মোথা দিয়েই ইট পোড়ানো হচ্ছে এখানে। ভাটা মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় সরকারী আইন মানছেন না তিনি।

দেদারছে কাঠ পোড়ানোর কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। সিকো ব্রিকসে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মন কাঠ মজুদ আছে বর্তমানে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জনবসতি থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা তৈরি করার কথা এবং সেটা হতে হবে অবশ্যই ফসলি জমি বাদে পতিত জমিতে। কিন্তু এ নিয়ম মানেনি সিকো ব্রিকস। জানা গেছে,সিকো ইট ভাটায় গড়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট উৎপাদন করতে প্রায় ছয় কোটি ঘুনফুট মাটি ও বালু ব্যবহার করা হয়। আর ওই মাটির সিংহভাগই ফসলি জমির উপরিভাগ থেকে কেটে নেওয়া হয়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে উপজেলার কোনও জমিতে ফসল উৎপাদন তো দূরের কথা এ অঞ্চল বিরান ভূমিতে পরিণত হবে বলে সচেতন মহলের দাবী। সিকো ব্রিকসের ম্যানেজার বলেন, ‘আমরা কৃষকদের কাছ থেকে উঁচু (টেক) জায়গা এবং ফিসারি থেকে মাটি কিনে ইট তৈরি করি।’ এবিষয়ে বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোঃ আব্দুল হালিম বলেন, সিকো ব্রিকফিল্ডে আমি পরিদর্শনে যাব।

তারা যদি কাঠ পুড়িয়ে থাকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এলাকাবাসী ও কৃষকদের অভিযোগ, উৎকোচ ও রাজনৈতিক প্রভাবে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে পরে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে লাইসেন্স নিয়ে ইটভাটা গড়ে হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর কোনও প্রতিকার করা হচ্ছে না। যেভাবে কাঠের কালো ধোঁয়া হচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্যহানি এবং পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের কাছে সিকো ব্রিকসে কাঠ পোড়ানো বন্ধের দাবি জানাই। ভাটার মালিক মোঃ ফারহান মনিরের ব্যবহৃত ০১৭৩৩…৩১৩ নাম্বারে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

আপনার মতামত লিখুন :