আজ বরিশাল মুক্ত দিবস

বিশেষ প্রতিবেদক॥ কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর । শহরে কারফিউ । সকাল গড়িয়ে গেল । তবুও নিস্তব্ধ শহর । বরিশালবাসীর মনে নানা সন্দেহ । কারফিউ অথচ রাস্তায় পাকিস্তানী সেনা নেই। মাথার উপরে বোমারু বিমান। আতঙ্কিত শহরবাসী । কিছুক্ষণ পর আতঙ্ক কেটে গেলো । বরিশালবাসী বুঝলো এ বিমান মিত্র বাহিনীর ।
আনন্দের করতালি। তখন কি এক বিজয়ের আনন্দে মানুষের বাধ ভেঙ্গে গেলো । রাস্তায় কিশোর -কিশোরীর জটলা । গুলির সচকিত শব্দ। তবুও কোন ভয় নেই। এসেছে মুক্তির লগ্ন।সে কি আনন্দ! সে কি জয়ধ্বনি! পথে পথে আনন্দে পাগল মানুষের উল্লাস।প্রিয়জনের ফিরে আসার প্রতীক্ষা, ধ্বংসস্তুপ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর স্বজন হরানোর শোকের ভেতরও এক পুলকিত স্বস্থির আবহ।খুলে গেল সবকটা জানালা। সূর্য উঠলো আরও রক্তিম বর্ণে।
ধান ক্ষেত আরও সতেজ হোল।আকাশে উড়লো মানচিত্র সেই পতাকা। আজ আট ডিসেম্বর। সেই দিন। বরিশাল মুক্ত দিবস।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার। কৃষ্ণপক্ষের রাত। পাকিস্তানী হানাদারদের নখরে ক্ষতবিক্ষত হলো ঢাকা। রক্তস্নাত হলো ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, মহসিন হল। রোকেয়া হলের প্রায় অর্ধশত ছাত্রী ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সম্ভ্রম বাঁচাল।
দখল হলো মেডিকেল কলেজ। শুরু হলো নির্বিচারে গণহত্যা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়লো ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর। একমাস মুক্ত ছিল বরিশাল। ২৫ এপ্রিল জল, স্থল ও সড়ক পথে ত্রিমুখী আক্রমণ চালালো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। ওদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে আমাদের মুক্তি সেনারা অসহায় হয়ে পড়লো। তবুও গৌরনদীর কটকস্থলে পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতিরোধ করলো মুক্তিযোদ্ধারা।
এখানে শহীদ হলো মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম, মোক্তার আলী, আলাউদ্দিন ও পরিমল। রক্তে লাল হলো বরিশালের সবুজ ধানক্ষেত। নৌপথে শহরতলী জুনাহারে মুক্তিযোদ্ধারা ২টি স্টিমার দিয়ে হানাদারদের পথ রোধ করে। কিন্তু হানাদারদের গানবোটের গোলায় প্রতিরোধকারী স্টিমার ২টি ডুবে যায়। এখানে নেতৃত্ব দেন সার্জেন্ট ফজলুল হক ও ক্যাপ্টেন মেহেদী। সম্মুখ যুদ্ধে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন ফিরু।
আকাশ পথে হেলিকপ্টার থেকে প্যারা ট্রপার নামানো হয়। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদারদের ত্রিমুখী আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। শহরে ঢুকে হানাদাররা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। চরবাড়িয়ায় ওই দিন পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে নিহত হয় শতাধিক মানুষ। বরিশালে বাঙালির রক্তের স্রোত বইয়ে পাকিস্তানী বাহিনী অশ্বিনী কুমার হল ও জিলা স্কুলে অবস্থান নেয়।
পরবর্তীতে ওয়াপদার ত্রিশ গোডাউনে স্থায়ী অবস্থান নেয়। এখানেই তৈরী হয় নির্যাতন সেল। দক্ষিণ পার্শ্বের ইটভাটাগুলো ছিল বধ্যভূমি।
দীর্ঘ ৯ মাসে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয় বরিশাল শহর, বাটাজোড়, আগৈলঝাড়া ও কলসকাঠী বন্দর। হানাদারদের অব্যর্থ নিশানায় শহীদ হয় শত শত নিরীহ বরিশালবাসী।
ওয়াপদায় একটি কক্ষে চলতো নারী ধর্ষণ। যারা সবটুকু আচল দিয়ে ঘোমটা টেনেও মায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। রক্তে লাল হলো কীর্তণখোলা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা ও ধানসিঁড়ি। বরিশালের থানা সদরগুলোতেও হানাদাররা ক্যাম্প করে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায়। এদিকে গ্রামে গ্রামে সংগঠিত হতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধারা।
ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মেজর এম এ জলিলকে এ অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার করা হলো। নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ শুরু করলো। ৬ ডিসেম্বর ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদান করে। গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্র বাহিনী। মুক্ত হতে থাকে সীমান্ত শহরগুলো। মিত্র বাহিনী ধীরে ধীরে শহরগুলোর দিকে এগোতে থাকে।
এদিকে পতন অনিবার্য জেনে ৭ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাকিস্তানী হানাদাররা ২টি জাহাজযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করে। কিন্তু মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় জাহাজ ২টি নদীতে নিমজ্জিত হয়। মুক্ত হয় ৯ মাসের অবরুদ্ধ বরিশাল। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মুক্ত বরিশাল। শহরে উৎসবের বন্যা। এ উৎসব প্রাণের, এ উৎসব আনন্দের।
আজ সেই দিন। কিন্তু কীর্তণখোলা তীরের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আজও মা অপেক্ষা করেন, বিজয়ী বেশে খোকা ফিরবেই। পরনে সেই শাড়ি, লাল পাড়, সবুজ জমিন। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। আঁচলে বাঁধা ডালের বড়িগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মায়ের দীর্ঘশ্বাসে কালবোশেখী ছোটে।বান আসে কীর্তনখোলায়। তবুও খোকা আর ফেরে না।