সরোয়ার-যুগের অবসান বরিশাল বিএনপিতে!
মজিবর রহমান সরোয়ার
বরিশাল নগরীর কাউনিয়ায় ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে টেক্সটাইল মিলে শ্রমিক নেতা সালামকে গুলি করে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে আত্মগোপন করেন তৎকালীন জেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার। গণআন্দোলনে একই বছরের ৬ ডিসেম্বর এইচ এম এরশাদ সরকারের পতন হলে অনুসারী শত শত নেতাকর্মী বর্ণাঢ্য মোটর শোভাযাত্রায় সংবর্ধনা দিয়ে তাকে এলাকায় ফেরান। এরপরই বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ার-যুগের সূচনা।
গত ৩১ বছর তিনিই একক আধিপত্যে দল পরিচালনা করেছেন। সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ, সিটি করপোরেশনের মেয়র, বরিশাল বিএনপির সভাপতি-সম্পাদক যখন যে পদ চেয়েছেন, সেটাই আদায় করেছেন। নিজে পদ নিয়েছেন এবং অন্যকে পদ দিয়েছেন। তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই ঝুলত বহিস্কারের খÿ। এককথায় দলে মজিবর রহমান সরোয়ার ছিলেন অপ্রতিরোধ্য নেতা। গতকাল বুধবার বরিশাল মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ছন্দপতন ঘটল। তিনি নিজে এবং তার অনুসারীরা পদ পাননি। যারা সরোয়ারের আধিপত্য খর্ব করতে গত এক বছরের বেশি সময়ে মাঠে সক্রিয়, সেই নেতাদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করা হয়েছে নবগঠিত তিন কমিটিতে। সরোয়ার এখন শুধু দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব।
রাজনৈতিক উত্থান :জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সরোয়ার শ্রমিক রাজনীতি দিয়ে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় এরশাদ শাসনামলে বেশিরভাগ সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম
নির্বাচনে (১৯৯১) তখনকার বরিশাল-৩ (হিজলা-মুলাদী) আসনে দলের মনোনয়ন দেওয়ার পর আবার তাকে সরিয়ে মোশারফ হোসেন মঙ্গুকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কয়েক মাস পরেই ভাগ্য খুলে যায় সরোয়ারের। বরিশাল সদর আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হলে শূন্য আসনের উপনির্বাচনে সাংসদ হন সরোয়ার। রাষ্ট্রপতির ছেলে ডা. এহতেশামুল হক নাসিম বিশ্বাস বিএনপির একটি অংশের নেতৃত্ব দিলেও সরোয়ার ছিলেন তার শক্ত প্রতিপক্ষ। ‘৯৬-এর নির্বাচনে সরোয়ার মনোনয়নবঞ্চিত হলে সদরে সাংসদ হন রাষ্ট্রপতিপুত্র নাসিম বিশ্বাস। ‘৯৮ সালের নভেম্বরে ডা. নাসিম বিশ্বাসের অকালমৃত্যুতে বরিশাল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনে সরোয়ার বাধাহীন আধিপত্য গড়ে তোলেন, যা অটুট ছিল গতকাল পর্যন্ত। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী চারদলীয় জোট শাসনামলে সরোয়ার একসঙ্গে সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ, জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ছিলেন। অর্ধশতাধিক সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। দলে এক নেতা এক পদ নীতি অনেক আগে চালু হলেও সরোয়ার দলের যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি এত দিন বরিশাল মহানগর সভাপতির পদও ধরে রেখেছিলেন।
সরোয়ারের রোষানলে পড়েছেন যারা :২০০৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সরোয়ার জাতীয় সংসদের হুইপ ও জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পাশাপাশি মেয়র পদেও দলের মনোনয়ন নেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র আহসান হাবিব কামাল ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবায়েদুল হক চাঁন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। এ কারণে বহিস্কৃত হয়ে প্রায় আট বছর দলের বাইরে ছিলেন তারা। ২০১০ সালের দিকে তারা দলে ফিরলেও নিজ শক্তিতে দাঁড়াতে পারেননি। চাঁন দক্ষিণ জেলায় পদ পেলেও দক্ষিণ ও উত্তর দুটি জেলা কমিটিই নিয়ন্ত্রণ করতেন সরোয়ার। নগর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরোয়ার জেলার সভাপতি পদ ছেড়ে মহানগরের সভাপতি পদে আসীন হন। আহসান হাবিব কামাল দলে ফিরলেও হারানো মহানগর সভাপতি পদ আর ফিরে পাননি। তিনি ২০১৩ সালে সিটি মেয়র নির্বাচিত হলেও দলে সুসংহত অবস্থান করতে পারেননি সরোয়ারের দাপটে। তার দাপটে কোণঠাসা হয়ে নব্বই দশকের ছাত্রদল নেত্রী বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার শিরিন ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতিতে জড়ান। একসময় সরোয়ারের আস্থাভাজন ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম রাজন। সরোয়ার অনুসারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতের পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে রাজন এখন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে গেছেন শহর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খসরু। বরিশাল নগরীর বাসিন্দা হয়েও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বরিশাল বিএনপিতে স্থায়ী অবস্থান নিতে পারেননি বলে দলে গুঞ্জন রয়েছে।
আধিপত্য খর্ব যেভাবে :বরিশাল বিএনপিতে প্রকাশ্যে সরোয়ার-বিরোধিতা শুরু হয় প্রায় দেড় বছর আগে। নব্বই দশকের ছাত্রদল নেতারা একজোট হয়ে প্রথমে ঘরোয়া সভা শুরু করেন। এ বছরের শুরুতে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান ফারুকসহ কমিটির বড় একটি অংশ। পরে ছাত্রদল-যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলেরও বড় অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সরোয়ারবিরোধী সবাই একসময় তার আস্থাভাজন ছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল, সরোয়ার দল কুক্ষিগত করে রাখতে অযোগ্যদের পদায়ন করেন, যোগ্যদের দূরে রাখেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহীনের মৃত্যুর পর সাবেক ছাত্রনেতাদের বাদ দিয়ে জিয়াউদ্দিন সিকদারকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে দলকে পকেটস্থ করেছেন সরোয়ার। এসব অভিযোগ নিয়ে প্রায় এক বছর কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন তার বিরোধীরা। তবে আস্থাভাজন জিয়াউদ্দিন সিকদারের সঙ্গেও শেষ পর্যায়ে সুসম্পর্ক ছিল না সরোয়ারের। ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গত মঙ্গলবার রাতে মহানগর বিএনপির (সদ্য সাবেক) সভা হলেও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার অভিযোগ করেন, সভার বিষয়টি তাকে জানাননি সভাপতি সরোয়ার। অথচ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সভাপতির নির্দেশে তার সভা আহ্বান করার কথা।
বুধবার নতুন কমিটি ঘোষণার পর মজিবর রহমান সরোয়ারের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি