ত্যাগীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না
অনলাইন ডেস্কঃ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিচিত ‘হাইব্রিডদের’ ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন উপেক্ষিত ‘ত্যাগী ও যোগ্য’ নেতাকর্মীরা। ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমাণ্ডের নির্দেশনার পরেও মূল্যায়ন হচ্ছেন না তারা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সংগঠনটিতে ভিড় করছেন নানা দিক থেকে ছুটে আসা ক্ষমতালোভীরা—যারা পরিচিতি পেয়েছেন অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড হিসেবে। অভিযোগ উঠেছে, এখন ‘তারাই’ দলটির কেন্দ্রের উপ-কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। অনুপ্রবেশকারী এসব হাইব্রিডদের রসানলেও পড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের। দলের দুঃসময়ে যারা এগিয়ে আসেন তাদের কেন মূল্যায়ন হয় না—এখন এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, ‘এ ব্যাপারে দলের সভাপতির একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তিনি ত্যাগীদের মূল্যায়নের বিষয়ে বার বার বলেছেন। তারপরও ত্যাগীদের মূল্যায়ন হয় না। এর কারণ কি? তাহলে কি হাইকমাণ্ডের নিদের্শনা উপেক্ষা করা হয়? আসলে সবাই দায়িত্ব পেলেই ত্যাগীদের মূল্যায়নের বিষয়টা ভুলে যান। তার চারপাশে থাকা আপনজনদেরই দায়িত্ব দেন। ত্যাগীরাও মান-অভিমানে অনেক সময় দূরে থাকেন। তাদের অভিমানে হাইব্রিডরা দলে প্রবেশের সুযোগ পায়।’আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রে আছি। আমরা চেষ্টা করি ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে। কেন্দ্র মূল্যায়ন করবে মহানগর ও জেলা কমিটিকে। জেলা মূল্যায়ন করবে উপজেলাকে। উপজেলা মূল্যায়ন করবে ইউনিয়নকে। ইউনিয়ন মূল্যায়ন করবে ওয়ার্ডকে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কি হয়? আমরা কি আসলেই ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে পারছি?’আওয়ামী লীগে এই প্রেডিয়াম সদস্য আরো বলেন, ‘বর্তমানে ত্যাগী বা পরীক্ষিতদের বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দলের গঠনতন্ত্র না মানা। আমরা যারা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছি তারা কি উপজেলা বা ইউনিয়নের সকল ত্যাগীকে চিনি? হয়তো কয়েকজনকে চিনতে পারব। কিন্তু সেখানে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা তো চিনে। তাহলে তারা কেন ত্যাগীদের কমিটিতে রাখেন না। সেটা খুঁজলেই দেখা যাবে অন্য বিষয়। যারাই দায়িত্ব পায় তারাই বলয় সৃষ্টি করতে চায়।’চলতি বছরের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের কমিটিতে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও নিজেদের লোক দিয়ে কমিটি দেয়া হয়েছে কিনা— তা খতিয়ে দেখা হবে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা বাদ পড়লে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সবাইকে বলব, সামনে যে কমিটিগুলো গঠন করা হবে, সেগুলোতে অবিতর্কিত এবং ত্যাগীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।’এব্যাপারে শুধু দলের সাধারণ সম্পাদকই নন, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সকলেই ত্যাগীদের মূল্যায়নের ব্যাপারে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কমিটি ঘোষণা করার সময় দেখা যায়, তাতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের নাম থাকে না। তাদের পরিবর্তে দেখা যায় হাইব্রিডদের নাম। এভাবে কমিটি থেকে ছিটকে পড়ছেন পরীক্ষিতরা।বরিশাল বিভাগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। দুর্দিনের সঙ্গী ত্যাগী নেতাকর্মীরা না থাকলে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারত না।’আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শক্তি হচ্ছে মাঠে থাকা ত্যাগী কর্মীরা। আওয়ামী লীগের প্রকৃত কর্মীরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। যখনই ক্রান্তিকাল এসেছে কর্মীরা দলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এখনো বাংলাদেশকে ৭৫-এর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এখনো বাংলাদেশকে সামপ্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। বঙ্গবন্ধু কন্যাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চলছে। এ সময় প্রয়োজন সংগঠনকে শক্তিশালী করা, ত্যাগী কর্মীদের এগিয়ে আসা।
ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হলে আমাদের মাঠের পরীক্ষিত কর্মী, ত্যাগী কর্মী, দুর্দিনের কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে।’আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগের কমিটি করার ক্ষেত্রে নয়, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য প্রার্থিতা মনোনয়নের সময়ও নানান অভিযোগ উঠছে। সেখানে ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে—এমন শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে দলের সভাপতির ধানমণ্ডিস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনেক প্রার্থীও পরিবর্তন করেছে দল। তৃণমূল থেকে পাঠানো রেজ্যুলেশন নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন ত্যাগীরা। তারা অভিযোগে বলেছেন, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে।এ নিয়েও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিদের্শনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিজের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নয়, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের রাজনীতি করতে হবে। অনেকেই ক্ষমতা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে যান—যা মোটেই কাম্য নয়। টাকা খেয়ে খারাপ লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠাবেন না। ত্যাগীরাই সুখে-দুঃখে দলের পাশে থাকবেন। তাই সৎ ও ভালো মানুষদের মূল্যায়ন করতে হবে। দুঃসময়ে বসন্তের কোকিলরা পাশে থাকবে না।’