বহুপ্রতীক্ষিত পায়রা সেতুর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
অনলাইন ডেস্কঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়াকাটাকে সরাসরি সড়কপথে সংযোগকারী পায়রা সেতুর উদ্বোধন করেছেন। এর মাধ্যমে উন্নয়নের মহাসড়কে আরও একটি স্বপ্ন পূরণ হলো দক্ষিণাঞ্চলবাসীর।ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকার খরস্রোতা পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতুটি।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি এই সেতুর উদ্বোধন করেন।সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত সড়কপথ ফেরিবিহীন হলো।
আগে বরিশাল থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা পৌঁছাতে হলে ছয়টি স্থানে ফেরি পার হতে হতো।আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে প্রথম লাউকাঠি নদে পটুয়াখালী সেতু নির্মাণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে কীর্তনখোলা নদীর ওপর শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু (দপদপিয়া সেতু), খেপুপাড়ায় আন্ধারমানিক নদের ওপর শহীদ শেখ কামাল সেতু, হাজীপুরে সোনাতলা নদীর ওপর শহীদ শেখ জামাল সেতু, মহিপুরে খাপড়াভাঙ্গা নদীর ওপর শহীদ শেখ রাসেল সেতু নির্মিত হয়। সর্বশেষ এই পায়রা সেতু নির্মিত হলো।এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, করোনা ঝুঁকিতেও এই সেতুর কাজ অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেষ্ট ছিলেন। সময় বর্ধন এবং নানাবিধ জটিলতার মধ্যেও প্রকল্পের পূর্ত কাজের চুক্তি মূল্য থেকে ৫২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে নান্দনিক শোভাম-িত এই সেতুটি ইতোমধ্যে স্থানীয় মানুষের নজর কেড়েছে। প্রতিদিন অগণিত মানুষ এ সেতুটি দেখার জন্য ভিড় করছে। বিশেষ করে রাতের আলোকিত সেতু মানুষকে আকৃষ্ট করছে।
তিনি বলেন, পায়রা সেতু নির্মাণের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সহজসাধ্য মনে হলেও এর তলদেশে পানির স্রোত ছিলো। তীব্র এবং নদীর গতি প্রকৃতি ছিলো অভিনব। যেটিকে পদ্মার সঙ্গে তুলনা করা চলে। এছাড়া চ্যানেলের তলদেশে গভীরতা পাওয়া যায় ৪৩ মিটার। আধুনিক প্রযুক্তি যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয়েছে এ সেতু নির্মাণে। ভায়াডাক্টসহ ৩৩৮টি পাইলের মধ্যে ৪০টি পাইলের গভীরতা ১৩০ মিটার। যা এ যাবতকালের সর্বাপেক্ষা গভীর। নদীর মধ্যে পিলার-টু-পিলার বা স্প্যানের গ্যাপ রাখা হয়েছে ২শ মিটার। এটিও এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।চার লেনের এই পায়রা সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার। প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। জলতল থেকে সেতুটি ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু।চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুর আদলে নান্দনিক নকশায় সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেতুর উভয় পারে সাত কিলোমিটারজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। নদীর মাঝখানে মাত্র একটি খুঁটি বা পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে না।এ ছাড়া এই সেতুতে ‘ব্রিজ হেলথ মনিটর’ (সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণব্যবস্থা) স্থাপন করা হয়েছে। এতে বজ্রপাত, ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচলে সেতুর কোনো ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হলে আগেভাগেই সংকেত পাওয়া যাবে।সেতুতে আধুনিক টোল প্লাজা নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুর উভয় পাশে যানবাহনের ওজন পরিমাপের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সরকার ২০১২ সালের মে মাসে পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।
২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।সেতুটি নির্মাণে অর্থায়ন করেছে কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ও ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। নির্মাণকাজ করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন।এদিকে পায়রা সেতু উদ্বোধনের ঘোষণার পরই সেতুর দুই পাড়ে হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়েন। এর আগে জনতা বাদ্যযন্ত্র সহকারে উপস্থিত হন সেতুতে। সেখানে দল বেঁধে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন তাঁরা।উদ্বোধনের পর মানুষের পাশাপাশি কিছু ছোট যানবাহন সেতু পেরিয়ে যায়। শুরুতে টোল ছাড়াই এসব যানবাহন সেতুর ওপর দিয়ে ছুটে চলে যায়। পরে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে কুয়াকাটা থেকে বরিশালগামী ডলফিন পরিবহনের একটি বাস বরিশাল যাওয়ার পথে টোলঘরে এসে থামে এবং টোল পরিশোধ করে। এ সময় আল্লার দান পরিবহনের একটি বাসও টোল পরিশোধ করে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যায়। ডলফিন পরিবহনের বাসচালক সাত্তার হাওলাদার বলেন, ‘ফেরিঘাটে অপেক্ষা ও গাড়ি নিয়ে ওঠা-নামাতে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এখন সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ে চলে যেতে পারব। খুব ভালো লাগছে। তবে বাসচালকেরা টোল বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন।’টোল প্লাজার ব্যবস্থাপক এম এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উদ্বোধনের পার টোল প্লাজা খুলে দেওয়ার পর অনেক গাড়ি আসছে। খুব ভালো লাগছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি তাঁরাও আনন্দিত।’বাসের যাত্রী কুয়াকাটার মহিপুরের মাছ ব্যবসায়ী আবু তালেব বলেন, ভাই, প্রথম যাত্রী হয়ে বাসে সেতু পার হচ্ছি। এমনিতেই সেতুটি দেখতে খুব সুন্দর। এরপর পরিবারের সবাইকে নিয়ে একদিন সেতু দেখতে আসব।এদিকে উচ্ছ্বসিত মানুষের ঢল নামে সেতুতে।
এলাকার শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে সেতুটি দেখতে ছুটে যায়। এ সময় কথা হয়, দুমকি উপজেলার জনতা কলেজের বিএ শিক্ষার্থী কুলকুম সিকদারের সঙ্গে। তিনি তাঁর পাঁচ বন্ধু নিয়ে সেতু দেখতে যান। কুলসুম বলেন, ‘বাড়ির কাছে সেতু দীর্ঘদিন ধরে দূর থেকে দেখেছি। কিন্তু আজ সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে চলছি। সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন সেতু এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। কী ভালো লাগছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।’পটুয়াখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান খান হাতে কয়েকটি রঙিন বেলুন নিয়ে পায়ে হেঁটে সেতু পার হচ্ছিলেন। প্রচ- গরমে ঘাম ঝরছিল তাঁর শরীর থেকে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বলেছেন দৃষ্টিনন্দন সেতু। আসলেই সেতুটি দেখার মতো। এত সুন্দর সেতু এই অঞ্চলে আর হয়নি। শুধু সেতুটি দেখতেই পটুয়াখালী শহর থেকে এসেছি। গরমে কষ্ট হলেও খুব ভালো লাগছে। এই সেতু পেয়ে আমরা গর্বিত।’পাশের বাউফল উপজেলার নওমালা থেকে সেতু দেখতে এসেছে দুই বন্ধু সোহেল ও শফিকুল। তারা এসএসসি পরীক্ষার্থী। সাইকেল চালিয়ে সেতু পার হয়ে ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তারা জানায়, দুই বন্ধু কথা দিয়েছিলাম সেতু উদ্বোধন হলেই দেখতে আসব। খুব সুন্দর সেতু, দেখতেও ভালো লাগছে। পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সাংসদ মো. মহিবুবুর রহমান বলেন, এই দৃষ্টিনন্দন পায়রা সেতু দক্ষিণাঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে বদলে দেবে। বিশেষ করে এই সেতু খুলে দেওয়ার পর বরিশাল থেকে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হবে।
পর্যটকদের কাছে কুয়াকাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা সেতুসহ ব্যাপক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীকে পটুয়াখালীবাসীর পক্ষে ধন্যবাদ জানান তিনি।অপরদিকে পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে প্রায় ১১২ কিলোমিটার বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের ফেরি বিড়ম্বনা বন্ধ হলো। সেইসঙ্গে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী ফেরিঘাটে বন্ধ হলো ফেরি চলাচল।রোববার (২৪ অক্টোবর) বেলা ২টার দিকে অনেকটাই নিস্তব্দ হয়ে যায় ফেরিঘাটসহ আশপাশের এলাকা। নেই চলাচলরত ফেরির ইঞ্জিনের শব্দ। আবার ঘাটে নোঙর করা ফেরিতে বাজেনি কোনো হুইসেল। ছিল না ঘাট কেন্দ্রীক মানুষের কোলাহল।তবে গতকাল রোববার সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ের থেকে বেশি কর্মব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন লেবুখালী ঘাটের শ্রমিক ও চার ফেরির ৪০ জন স্টাফ।তারা জানান, পায়রা সেতু উদ্বোধনকে ঘিরে রোববার সকাল থেকেই গাড়ির চাপ ছিল লেবুখালী ফেরিঘাটে। সাধারণ পরিবহনের সঙ্গে অতিথিদের গাড়ির চাপ বাড়ায় চারটি ফেরি চালানো হয়েছে। যদিও এ ঘাটের শেষ কর্মদিবসের সকালে কাজের চাপ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তাদের। তবে স্মৃতির পাতা হাতড়ে কিছুটা খারাপ লাগার কথা জানিয়েছেন অনেকেই।লেবুখালী ঘাটের ফেরির চালক জাকির হোসেন বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এখানে কাজ করেছি, বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ ঘাটে।
আজ ঘাটের শেষ কর্মদিবসে কিছুটা খারাপ লাগলেও সেতুটি যে উদ্বোধন হচ্ছে এটাই ভালো লাগা। আমাদের চাকরিটাই এমন, আজ এই ঘাটে তো কাল ওই ঘাটে।মাহাবুবুর রহমান নামে অপর ফেরি চালক বলেন, সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি লাঘব হচ্ছে এটাই ভালো লাগা। আবার এখানকার ফেরিগুলো অন্য কোথাও মানুষের দুর্গোভ লাঘবে কাজে আসবে।তবে ফেরির সঙ্গে সঙ্গে ঘাটের ওপর নির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররাও অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পরেছেন। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সেতুর কারণে ঘাটের তেমন কারোরই কোনো সমস্যা হয়নি। ফেরির ঢালে পটুয়াখালী প্রান্তে অবস্থিত পাগলার মোড় এবং বরিশাল প্রান্তে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের পাশে দু’টি বড় বাজারের মতো গড়ে উঠেছে। যেখানে ঘাটের ব্যবসায়ীরা তাদের অবস্থান খুঁজে নিয়েছেন। আর এ দুই স্থানেই যাত্রীবাহীসহ পণ্যবাহী পরিবহন বিরতি দিবে, তাই সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হকারদেরও উপস্থিতি স্বাভাবিক থাকছে।এদিকে ঘাটের স্টাফরা জানান, লেবুখালি ঘাটের সচল ফেরিগুলো বেকুটিয়া, মাছুয়া ফেরিঘাটে যাবে। আর প্রয়োজন অনুসারে গ্যাংওয়ে পল্টুনও সরিয়ে নেওয়া হবে অন্যত্র।