তালেবান সরকার ও তার শত্রু-মিত্র

NEWSNEWS
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  09:20 AM, 11 October 2021

তালেবান সরকার ও তার শত্রু-মিত্র

তালেবান যতটা ঝোড়ো গতিতে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশ (পানশির ব্যতীত) দখল করেছিল, ততটা গতিতে সরকার গঠনে তৎপর হয়নি। খানিক সময় নিয়ে দেখে-শুনে-বুঝে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে। ইতোপূর্বে ক্ষমতার স্বাদ একবার গ্রহণ করলেও ক্ষমতা ধরে না রাখার কারণ অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ করছে তালেবান। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় তালেবান শাসনে নানা যুতসই দাওয়াইয়ের কথা বললেও কার্যত শরিয়াহভিত্তিক শাসন কায়েমে তারা বদ্ধপরিকর। তালেবান মুখে বলেছে- আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই; দেশের ভেতরে বা বাইরে কোনো শত্রু চাই না। অথচ তালেবানি হুকুমত কায়েম করতে আফগানিস্তানের ভেতর যারপরনাই কর্মকাণ্ড তারা চালাচ্ছে। গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট আশরাফ গানি সরকারের যবনিকা ঘটে। শুরুতে তালেবান অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন, সব আফগানের জন্য নিরাপদ আবাসের কথা বললেও সরকার গঠন ও পরিচালনায় নতুন মোড়কে পুরোনো ধ্যান-ধারণাই চলে এসেছে।

তালেবান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে, তার মধ্যেই আগামী দিনের তালেবান শাসনের ধরন বোঝা যাচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে মন্ত্রীদের সামরিক, গোয়েন্দা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ ১৩টি কমিশন গঠন করে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৬ সদস্যের ‘রাহবারি শূরা’ যা সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সবকিছুর পরও সুপ্রিম লিডার হায়তুল্লাহ আখন্দজাদার নির্দেশনা ও পরামর্শেই চলবেন প্রধানমন্ত্রী মোল্লাহ মোহাম্মদ হাসান আখুন্দসহ অন্য মন্ত্রীরা।

যেভাবেই দেখা হোক না কেন, তালেবানের নিয়ন্ত্রণে এখন আফগানিস্তান। তিন কোটি ৯০ লাখ আফগানবাসীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে তালেবান এদের স্বপ্টেম্নর খেলাফত কায়েমের চেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি। যদি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সখ্য না গড়তে পারে তালেবান, তবে নিজস্ব সামর্থ্য দিয়ে আফগান জনগণের অতি জরুরি রসদের জোগান সম্ভব নয়। তালেবানের সব সময়ের বন্ধু খোদ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি সম্প্রতি বলেছেন, তালেবান প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখলে তাদের জন্য গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি আদায় সম্ভব। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে- তালেবান হচ্ছে বাস্তবতা। ইচ্ছা করলেই এটা পাল্টানো সম্ভব নয়। তালেবান যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষায় উদ্যোগী হয়, তবেই আন্তর্জাতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহায়তা প্রদানে অনুপ্রাণিত হবে। তালেবান এসব বিষয় অনুধাবন করে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে এবং সুহাইল শাহিনকে জাতিসংঘের নতুন আফগান দূত মনোনীত করেছে।

অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই তালেবানের হাতে। শুধু ৯৯ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাওয়াই জনগণ খাবে না। মানুষের সামনে এখন মৌলিক চাহিদাগুলোর সমস্যার বিষয় পাহাড়সম। এখনও আফগানিস্তান সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্য এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ ও গভীর অর্থনৈতিক সংকটের দেশ। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান আজমল আহমাদি বলেছেন, আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে ক্যাশ টাকা নেই বললেই চলে। তালেবান ক্ষমতা দখলের আগে আফগানিস্তানের জাতীয় আয়ের প্রধান নিয়ামক ছিল বৈদেশিক সাহায্য। তালেবান শাসনে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ দুটোই ঝুঁকির সম্মুখীন।

তালেবান আয়ের অন্যতম উৎস মাদকের বিকল্প কৃষিপণ্য উৎপাদনে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে। এ বাস্তবতায় নয়া কট্টর মৌলবাদী সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির চাকার প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে কতটুকু- এটা বড় প্রশ্ন। মাত্র ৫০০ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে তালেবান সরকার নিত্যদিনের চাহিদার জোগান মিটিয়ে ৩৭ লাখ শিক্ষাবঞ্চিত শিশুকে শিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে উন্নয়নের মূলধারায় সংযুক্ত করবে- এটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বহির্বিশ্বে তালেবান এখনও সম্পর্কোন্নয়নে দৃশ্যমান কর্মযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তালেবানের বন্ধু হিসেবে পাকিস্তান ২৪০০ কিলোমিটার সীমান্তে আফগানের সঙ্গে যুক্ত। এদের বাইরে তালেবানের যাওয়ার সুযোগ কম। রাশিয়া ভূ-রাজনীতিতে এখন তালেবানকে সমর্থন দিলেও ১৯৭৯-৮৯ মেয়াদে ১০ বছরের আফগান-রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষত ভুলতে পারবে না। মূলত দ্বৈত নীতিতে রাশিয়া রাজনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে তালেবানকে সমর্থন দিলেও তালেবানি তাণ্ডব যেন ককেশাস দেশগুলোতে ঢুকতে না পারে, সে ঝুঁকি এড়াতে চাচ্ছে। প্রতিবেশী চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ আফগান সিল্ক্ক রোডের (এশিয়া টু ইউরোপ) সুবিধা আদায়ে তালেবানের সঙ্গে একাট্টা। কাজেই চীনের স্বার্থ পুষিয়েই দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে তালেবানের। শিয়াপ্রধান ইরান সুন্নি তালেবানের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে আফগানিস্তানে শিয়া হাজরা সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায়। দৃশ্যত প্রত্যেক মিত্রের স্বার্থ রক্ষা করেই তালেবান সরকারকে পথ হাঁটতে হবে। পৃথিবীর প্রভাবশালী ধনী রাষ্ট্র তালেবানি ব্যবস্থাকে নীতিগতভাবে সমর্থন করে না। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল বলেছেন, আফগান শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নির্ভর করছে তাদের কাজ ও আচরণের ওপর। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আনন্দে বিভোর হয়ে অতিশয় আচরণ করলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে তাগিদ রয়েছে সহায়তার পূর্বশর্ত হিসেবে, তালেবান যদি সে পথে হাঁটতে না পারে তবে তালেবানের গতি ও গন্তব্য তারাই নির্ধারণ করবে। সমস্যা হচ্ছে আফগান জনগণের। তারা কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের জীবনে ফিরতে চাইবে না। এখন তালেবানকে আফগান জনগণকে নিয়েই টিকে থাকার পথ খুঁজতে হবে।

আপনার মতামত লিখুন :