চীনা ঋণ নিয়ে কীভাবে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বহু দেশকে অনলাইন ডেস্ক
চীন আর লাওসের সংযোগকারী ইউমো রেললাইন প্রকল্পের কাজ চলছে-বিবিসি
চীন আর লাওসের সংযোগকারী ইউমো রেললাইন প্রকল্পের কাজ চলছে-বিবিসি
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন চীন নিজেই বিদেশি অর্থসাহায্য নিত। তবে এখন চীনের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিচ্ছে দেড় শতাধিক দেশ।
নতুন এক হিসাবে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্য প্রধান শক্তিধর দেশগুলো অন্য দেশকে উন্নয়নের জন্য যে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে তার কমপক্ষে দ্বিগুণ বেশি অর্থ দিচ্ছে চীন। খবর বিবিসির
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম এ্যাণ্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটার এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১৮ বছরে চীন মোট ১৬৫টি দেশে ঋণ হিসেবে ৮৪ হাজার ৩শ’ কোটি ডলার অর্থ দিয়েছে এবং তা খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৪২৭টি অবকাঠামো প্রকল্পে।
এই অর্থের অধিকাংশই হচ্ছে চীনের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে আসা এবং এগুলো দেওয়া হয়েছে চড়া সুদে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঋণ’ হিসেবে।
এর এক বড় অংশই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন নতুন পথ নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে এ প্রকল্প শুরু হয়।
সমালোচকরা আশংকা প্রকাশ করেন, যে চড়া সুদের যেসব ঋণ থেকে চীনের এসব প্রকল্পের অর্থায়ন হচ্ছে – তা অনেক দেশের জনগণের অগোচরেই তাদের কাঁধে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
এখন চীনা কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। এইডডাটার গবেষকরা চার বছর ধরে অনুসন্ধান করেছেন, চীনের দেওয়া ঋণ সারা বিশ্বে কোথায় কোথায় যাচ্ছে এবং তা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে। তারা বলছেন, চীন সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো নিয়মিত তাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছেন যে তাদের অর্থ বিদেশে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এইডডাটার নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড পার্কস বলছেন, তাদের সঙ্গে চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের সব সময়ই কথা হচ্ছে এবং তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণভাবে তারা এসব উপাত্ত হাতে পান না।
চীনের দেওয়া ঋণে অর্থায়িত উদ্যোগগুলোর একটা বড় উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে চীন ও তার প্রতিবেশী লাওসের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পটিকে।
গত কয়েক দশক ধরে রাজনীতিবিদরা এমন একটি সংযোগের স্বপ্ন দেখছিলেন, যাতে ভূ-বেষ্টিত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হতে পারে।
কিন্তু প্রকৌশলীরা বলেছেন, এ প্রকল্প হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ এই রেললাইন পাততে হবে উঁচু পার্বত্য এলাকা দিয়ে, অনেকগুলো সুড়ঙ্গ ও সেতু বানাতে হবে। লাওস একটি গরিব দেশ এবং এ প্রকল্পের সামান্য অংশের খরচ মেটানোর ক্ষমতাও তাদের নেই।
কিন্তু চীনের উচ্চাভিলাষী ব্যাংকাররা মঞ্চে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই এই চিত্র পাল্টে গেল। চীনের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এবং রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের একটি কনসোর্টিয়াম এ প্রকল্পে সহায়তা দিল। মোট ৫৯০ কোটি ডলারের সেই রেললাইন এখন চালু হওয়ার পথে।
তবে লাওসকে এ জন্য ৪৮ কোটি ডলারের একটি ঋণ নিতে হয়েছিল একটি চীনা ব্যাংক থেকে, যাতে ওই প্রকল্পে দেশটির যে ইকুইটি তার অর্থায়ন করা যায়।
লাওসের অর্থনীতিতে সামান্য যে কয়েকটি খাত লাভজনক তার একটি হচ্ছে তাদের পটাশের খনি। এই খনির আয়কে কাজে লাগিয়ে দেশটি সেই বিশাল ঋণ নিয়েছিল।
হংকংএর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী অধ্যাপক ওয়ানজিং কেলি চেন বলছেন, লাওসের ইকুইটি অংশ অর্থায়নের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক যে ঋণ দেয় তাতেই বোঝা যায় চীনা রাষ্ট্র এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কতটা আগ্রহী ছিল।
এই রেললাইনের অধিকাংশেরই মালিক চীনা-নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে গ্রুপ। কিন্তু চুক্তিটা করা হয়েছে এমনভাবে যে রেলপথের ঋণের জন্য চূড়ান্তভাবে দায়ী হচ্ছে লাওস সরকার। এই চুক্তির কারণে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছে লাওসের রেটিং একেবারে নিচে নেমে যায়।
লাওস দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন দেশটি চীনা দাতাদের ঋণের ভার হালকা করতে তাদের একটি বড় সম্পদ জ্বালানি গ্রিডের একাংশ ৬০ কোটি ডলারে চীনের কাছেই বিক্রি করে দিল।
এ ঘটনা যখন ঘটছে তখনও সেই রেললাইন চালুই হয়নি। লাওসের রেল প্রকল্প যে চীনা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর একমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ তা মোটেও নয়। কিন্তু তারপরও অনেকগুলো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের কাছে অর্থের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে চীন।
ব্র্যাড পার্কস বলছেন, কোনো এক বছরে চীনের গড় আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ হচ্ছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এর সঙ্গে তুলনায় দেখা যাচ্ছে – যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর বৈশ্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে যে সহায়তা দিচ্ছে তার পরিমাণ হলো মাত্র প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রে চীন অনেক আগেই অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বেইজিং যেভাবে এ স্তরে উন্নীত হয়েছে তা একেবারেই ব্যতিক্রমী বলছে এইডডাটা।
অতীতে এক সময় আফ্রিকান দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলার জন্য দোষ দেওয়া হতো পশ্চিমা দেশগুলোকে। চীন এসব দেশকে অর্থ ঋণ দিচ্ছে অন্য কায়দায়। এখানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঋণের মাধ্যমে প্রকল্প অর্থায়ন করা হচ্ছে না। বরং চীন যে ঋণ দিচ্ছে তার প্রায় সবটাই আসছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণ হিসেবে।
গ্রহীতা দেশের সরকারি ঋণের যে আনুষ্ঠানিক বিবরণ থাকে তাতে চীন থেকে নেওয়া এসব ঋণের কথা উল্লেখ করা হয় না। কারণ চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে করা এসব চুক্তিতে অনেক সময়ই কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না। ফলে এসব চুক্তি থেকে যায় সরকারের দলিলপত্রের বাইরে। তা ছাড়া এতে গোপনীয়তা সংক্রান্ত যেসব ধারা থাকে তার ফলেও সরকার জানতে পারে না ঋণ নেওয়ার সময় বন্ধ দরজার ওপাশে ঠিক কী সমঝোতা হয়েছিল।
এইডডাটা বলছে, এই ধরনের অজানা ঋণের পরিমাণ ৩৮.৫০০ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
চীন যেসব রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ঋণ দেয় তার বিপরীতে অনেক সময় অস্বাভাবিক ধরনের কোল্যাটেরাল দাবি করা হয়। ইদানিং প্রায়ই চীনা ঋণ গ্রহীতাকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া নগদ অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার করতে হচ্ছে।
ব্র্যাড পার্কস বলছেন, অত্যন্ত দরিদ্র কোনো দেশের আয় করা ডলার বা ইউরো এভাবে একটি বিদেশের এ্যাকাউন্টে আটকে থাকছে যার নিয়ন্ত্রক একটি বিদেশি শক্তি।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আ্যানা জেলপার্ন বলছেন, চীন এখানে বলা যায় বুদ্ধি এবং জোর খাটিয়ে তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করছে।
তিনি বলছেন, অনেক দেশই আছে যারা ঋণগ্রহীতা হিসেবে সুবিধের নয়। তাই তারা যদি ঋণ শোধ করতে না পারে, তখন এটা আশা করা যায় না যে তারা বন্দরের মত একটা অবকাঠামো বা সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দেবে