এম.কে. রানা, বরিশাল ॥
দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সবকিছুতেই যেন আধুনিকতার ছোঁয়া। যা থেকে বাদ পড়েনি প্যাডেল রিক্সাও। যান্ত্রিকতার এ আধুনিক যুগে কর্মজীবী মানুষের জন্য এখন পেশীশক্তির বদলে আবিষ্কার হয়েছে ইলেক্ট্র্রনিক ও সহজলভ্য যানবাহন। পেশি শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে যতটা আরাম আয়েশে কর্ম করা যায় মানুষ এখন সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাই পায়ে চালিত রিক্সার প্যাডেলের পরিবর্তে মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছে যান্ত্রিক এই ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সার প্রতি। তবে খেটে খাওয়া দিনমজুরদের সকলের সামর্থ্য না থাকায় অনেকেই এখনো পায়ে প্যাডেল দিয়ে রিক্সা চালাচ্ছেন। কিন্তু যান্ত্রিক রিক্সা সাথে পেরে উঠছে না পেশি শক্তি দিয়ে প্যাডেল চালিত রিক্সা। ফলে দুর্দিন পোহাতে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের অসহায় রিক্সা শ্রমিকদের। অন্যদিকে দক্ষিণের জনপদে হারিয়ে যেতে বসেছে প্যাডেল রিক্সা।
মহামারী করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া কম শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষত কিংবা দিনমজুরের কাজ করা লোকেরাই এখন বেশিরভাগ ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সার চালক। ব্যাটারি চালিত রিক্সায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকলেও এটাই এখন কর্ম হারানো মানুষের প্রথম পছন্দ। কারো কারো মতে অলস মানুষের পেশা হিসেবে ব্যাটারি চালিত রিক্সাই বেশি পছন্দ। এদিকে বরিশালসহ দক্ষিণের সকল জেলা উপজেলায় অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্করা ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। তবে ওই সব অটোরিক্সা চালকদের ভাষ্য, করোনাকালীন সময়ে চাকরি হারালেও ব্যাটারীচালিত রিক্সা চালিয়ে কোন রকম খেয়ে পড়ে বেঁচে আছেন তারা।
সূত্রমতে, ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা আসার পর প্যাডেল রিক্সার জায়গা পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন তারা। বছর তিন চারেক আগেও বরিশাল নগরীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল রিক্সা। বর্তমান সময়ে বরিশাল নগরীর শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল গেটে, লঞ্চঘাট, চকের পোল, বিবির পুকুর পাড়, জেলখানার মোড়, নতুন বাজার ও হাতেম আলী চৌমাথা এলাকায় মাঝেমধ্যে হাতেগোনা একটা দু’টো প্যাডেল রিক্সা দেখা যায়। যে দু’একটি দেখা যায় সেগুলোও হয়ত অল্প দিনের মধ্যেই হারিয়ে যাবে। অথচ এক সময় বরিশাল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ও আনাচে কানাচে দেখা যেত রিক্সা। রিক্সার প্যাডেল ঘুরিয়ে সংসার চলত শত শত মানুষের। কিন্তু বর্তমান সময়ে নগরীসহ গোটা বরিশাল বিভাগ জুড়েও খুব একটা দেখা মেলেনা প্যাডেল রিক্সার। নগরীর মধ্যে যে সকল প্যাডেল চালিত রিক্সা চলাচল করে সেগুলোর চালকরাও বেশ বয়স্ক। তারা তাদের পেশি শক্তি দিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারেন না যাত্রীদের।
নগরীর সদর রোডে রিক্সা চালক মোতালেব ফকির (৫৬) বলেন, ‘গত ১৯ বছর ধরে বরিশাল শহরে রিক্সা চালাই। এখনো রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছি। গত ৭-৮ বছর আগেও প্রতিদিন ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা আয় করতে পারতাম। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিক্সা চালিয়ে সাড়ে ৩ শত থেকে সাড়ে চার শত টাকা আয় হয়। আবার কোনো কোনো দিন সেটা হয়ও না। মানুষ এখন আর রিক্সায় উঠতে চায় না। আমাদের অটো রিক্সা কেনার টাকা নেই এজন্য বাধ্য হয়ে প্যাডেল রিক্সাই চালাতে হয়”। নতুন বাজার এলাকার রিক্সা চালক সুফিয়ান ভূঁইয়া (৫৮) বলেন, ‘এখন মানুষ অলস হয়েছে। মানুষের সময় কমে গেছে। কেউ রিক্সায় চড়ে দূরে কোথাও যেতে চায় না। আমরা দিনরাত যে টাকা আয় করি তা দিয়ে সংসার চলে না। দীর্ঘদিন ধরে রিক্সা চালিয়ে আসছি। এটা ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য কোনো পেশায় যাব তারও উপায় নেই।
নগরীর একাধিক প্রবীণ লোকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, ‘আমরা ৫-৭ বছর পূর্বে বাজার করা সহ বিভিন্ন কাজে বের হলে এ শহরে রিক্সাতেই ঘুরে বেড়াতাম। তাছাড়া সেই সময়ে এতো মোটরসাইকেলর ব্যবহার ছিল না। অধিকাংশ মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে প্যাডেল রিক্সায় চড়েই অফিস, আদালত ও দোকানপাটে পৌঁছাতে। খুব ভালো ছিল সেই দিনগুলো। তারা বলেন, বর্তমানে মানুষের মধ্যে অলসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অটো চালকরা পায়ের উপর পা তুলে অটো চালায়। এতে দুর্ঘটনাও ঘটে। বর্তমানে শহরে যে পরিমান ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সা চলাচল করে তাতে এই শহর থেকে প্যাডেল রিক্সা-ভ্যান বিলুপ্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।